বিস্ময়কর যোদ্ধা ছিল নিনজারা
নিনজা বললেই যে ছবিটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তা হলো একজন অতি মানব ক্ষমতাধর মানুষ, যে জলের ওপর দিয়ে হাঁটতে পারে, উঁচু প্রাচীর অনায়াসে টপকে যেতে পারে। যদিও বেশিরভাগ আধুনিক সিনেমাতেই আমরা এক অজেয় যোদ্ধা-নায়ক হিসেবে নিনজাদের দেখতে পাই। কিন্তু সত্যিকারে নিনজারা কেমন ছিল, সেই গল্প বেশি রোমান্সকর। বীরযোদ্ধা সামুরাইদের মতো জাপানেরই আরেক সামরিক যুদ্ধবিদ ছিল নিনজারা। সাধারণ সৈন্যদেরচেয়ে অনেক উঁচু পদের অধিকারী এইনিনজারা ছিল অত্যন্ত নিপুণ ও ধুরন্ধর সৈনিক। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ অথবা পঞ্চম শতকে সান জু'র লেখা 'দ্য আর্ট অব ওয়ার' নামে একটি বিখ্যাত বইয়ে এ নিনজাদের কথা প্রথম পাওয়া যায়
। জাপানের মানুষ মনে করে, এ সৈনিকদের আবির্ভাব চতুর্দশ শতকে। সে সময় জাপানে অনেক ছোট ছোট সামন্তরাজা ছিলেন, তাদের মধ্যে সারা বছরই গোলমাল লেগে থাকত। মুখোমুখি যুদ্ধে বিপক্ষকে পরাস্ত করার জন্য গোপনে কাজ হাসিল করতেই তারা বেশি পছন্দ করত। অথচ সামুরাইদের নীতিজ্ঞান ছিল প্রখর। তারা এ ধরনের অন্যায় কাজকে ঘৃণার চোখে দেখত। তাই সামন্তরাজারা তাদের রাজত্ব সুরক্ষিত রাখার জন্য নিনজাদেরই সাহায্য নিতেন। নানা ধরনের মার্শাল আর্ট ছাড়াও গুপ্তচরবৃত্তি, অন্তর্ঘাত ও গুপ্তহত্যার কাজে নিনজাদের দক্ষভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলা হতো। সে সময় জাপানে মেয়েরাও নিনজা হতো, তাদের বলা হতো 'কোনুইচি'। শারীরিক কৌশল ছাড়া অভিনয় ও মনোরঞ্জনে দক্ষ করে তোলা হতো এ মেয়েদের। সাধারণত কোনো বাড়িতে তারা পরিচারিকার ছদ্মবেশে ঢুকত, তারপর গোপন খবরা-খবর সব জোগাড় করে আনত। যে নেতার নির্দেশে কাজ করত, সেই নেতার পরিচয় গোপন রাখা ছিল তাদের প্রধান দায়িত্ব। যদিও আমরা সিনেমায় বা কার্টুন চরিত্রে নিনজাদের কালো পোশাকে ঢাকা দেখতেই অভ্যস্ত, কিন্তু তারা গরিব কৃষকদের মতোই সাধারণ জামা-কাপড় পরত। কখনও আবার সামুরাইদের মতো পোশাকও পরত। তাই নিনজাদের শনাক্ত করা যেত না সহজে। নিনজারা 'আশিয়ারো' নামের একরকম কাঠের টুকরো জুতার সঙ্গে আটকে রাখত। ফলে তাদের পায়ের ছাপগুলো দেখতে বাচ্চাদের বা খরগোশের মতো। তাই কখন তারা কোন রাস্তা দিয়ে যেত, কেউ খুঁজে পেত না।
এ ছাড়া তারা আঙ্গুলে 'শোবো' নামে এক ধরনের ছোট্ট কাঠের আংটি পরত। সেটি দেখতে ছোট হলেও হাতাহাতি লড়াইয়ের সময় বিপক্ষকে ঘায়েল করতে ভূমিকা নিত। ওই আংটিতে একটা কাঠের খাঁজ থাকত, যেটি শত্রুকে আঘাত করে সাময়িকভাবে অসাড় করে রাখত। এরই সমকক্ষ হলো 'সানটেটসু', কাঠের ছোট ডিমের মতো এই টুকরোটিকে আঙুলের সঙ্গে বেঁধে নিন্জারা হাতের পাতায় ধরে থাকত। তারপর সুবিধামতো বিরোধী পক্ষকে একইভাবে কাবু করে ফেলত। নিনজারা অনেক অনেক সময় ছাপোষা কৃষকের ছদ্মবেশ ধরত বলে তাদের অস্ত্রশস্ত্রগুলো আবার একই সঙ্গে চাষের কাজেও ব্যবহারের মতো করে তৈরি করা হতো। কয়েক শতাব্দী ধরেই জাপানের লোকগাথা, সাহিত্য এবং পারফরমিং আর্টে নিনজারা উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে রয়েছে। সত্যিকারের নিন্জারা কীরকম ছিল, সেটা যেহেতু সঠিকভাবে জানা যায় না, তাই তাদের সম্বন্ধে যে গল্প প্রচলিত, সেগুলো কিন্তু বেশিরভাগই অতিরঞ্জিত। ১৯১৬ মালে 'Koga Union Nigjusta Kogaryu' নামে একটি নির্বাক সিনেমাকেই প্রথম নিনজাদের নিয়ে তৈরি ফিল্ম হিসেবে ধরা হয়। পাঁচের দশক ও ছয়ের দশকের গোড়ার দিকজুড়ে জাপানের কিশোর সাহিত্য ও সিনেমায় নিনজাদের প্রতিপত্তি শুধু জাপানেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু আটের দশকের প্রথম দিকে আমেরিকায় শো কোসুগি অভিনীত বেশকিছু নিনজাদের সিনেমা রিলিজের পরই এদের খ্যাতি বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য বিভিন্ন কমিকস্ ও ভিডিও গেমস্-এর জনপ্রিয় চরিত্র হিসেবে নিনজাদের পথচলা এখনও শেষ হয়নি।
ভাল হয়েছে চালিয়ে যান
ReplyDeleteThanks
ReplyDelete