যেভাবে আন্তর্জাতিক মর্যাদা পায় অমর একুশে
১৯৫২ থেকে ১৯৯৯। ব্যবধান ৪৭ বছর। ৫২-তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার। এ অধিকারের বিশ্বস্বীকৃতি মিলেছে ১৯৯৯ সালে। ৫২'র ভাষা আন্দোলনের শহীদদের নাম রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার। ৯৯তে বাংলার আন্তর্জাতিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার যোদ্ধাদের নামও রফিক-সালাম। নামের কী অপরূপ মিল! ৯৯'র রফিক-সালাম প্রবাসী বাঙালি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাদের অবিরাম দেনদরবার ও অক্লান্ত পরিশ্রমের সফল পরিণতিতে ২১ ফেব্রুয়ারি পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা।
২১ ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'-এ মর্যাদাসীন করার ভাবনা মাথায় আসার পর থেকেই কানাডার ভাঙ্কুভারে প্রবাসী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ শুরু করেন। ৫২'র রফিক-সালামদের অবদানের সম্মানার্থে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার দাবি জানিয়ে তারা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের কাছে আবেদন-নিবেদনে নৈতিক সমর্থন পেতে থাকেন। সবাই তাদের দাবির যৌক্তিকতা-ন্যায্যতা স্বীকার করে। সমর্থনও জানায়। কিন্তু এ ধরনের দাবি প্রতিষ্ঠায় তাদের সীমাবদ্ধতার কথাও উল্লেখ করে। এক পর্যায়ে রফিক-সালাম ১৯৯৮ সালের জানুয়ারিতে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানকে একটি চিঠি লেখেন। কিন্তু জবাব মিলছিল না। তারা বুঝতে পারেন_ ব্যক্তিগত বা এককভাবে এগিয়ে তারা সুবিধা করতে পারবেন না। তাই পরে তারা প্রতিষ্ঠা করেন 'ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভারস অব দ্য ওয়ার্ল্ড' নামে একটি বহু ভাষাভাষী সংগঠন। এ সংগঠন থেকে আবার চিঠি লেখেন কফি আনানের কাছে। এ চিঠির জবাবের আশায় এক বছর অপেক্ষার পর জাতিসংঘ থেকে একটি দিকনির্দেশনা আসে। দিকনির্দেশনা অনুযায়ী তারা ধরনা দেন প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দফতরে। সেখান থেকে ১৯৯৯ সালের এপ্রিলে তাদের জানানো হয়, তোমাদের বিষয়টি খুব ইন্টারেস্টিং। ইউনেস্কো এ ধরনের প্রস্তাব পেলে তা বেশ গুরুত্ব দেয়। তবে এরকম প্রস্তাব পাঠানোর নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। ইউনেস্কো সম্মেলনে এ ধরনের প্রস্তাব কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে এলে চলবে না। তা আসতে হবে কোনো সদস্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে।
এ পরিস্থিতিতে রফিক-সালাম বিষয়টি সবিস্তারে ব্যাখ্যা দিয়ে যোগাযোগ করেন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে। বিষয়টি অক্টোবরে প্যারিসে অনুষ্ঠেয় ইউনেস্কো সম্মেলনে উত্থাপন করতে তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ কামনা করেন। এএসএইচকে সাদেক তখন শিক্ষামন্ত্রী। আর শিক্ষাসচিব কাজী রকিব উদ্দিন। মন্ত্রীকে বিষয়টি সবিস্তারে অবহিত করেন সচিব। হাতে সময় খুবই কম। আনুষ্ঠানিকভাবে ইউনেস্কো সদর দফতরে এ প্রস্তাব পাঠানোর শেষ তারিখ ছিল ১০ সেপ্টেম্বর। বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানান শিক্ষামন্ত্রী সাদেক। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টির গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করেন। সময় নষ্ট না করে তিনি দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলেন শিক্ষামন্ত্রীকে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পেয়ে শিক্ষামন্ত্রী তার মন্ত্রণালয়ের দক্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি টিম গঠন করেন। টিমটি এ নিয়ে দিন-রাত খাটাখাটুনি শুরু করে। ফাইলপত্র চূড়ান্ত করে শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে পদ্ধতি অনুযায়ী প্রস্তাবটি পাঠানো হয় ইউনেস্কোতে। ১৯৯৯'র ২৬ অক্টোবর-১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ সম্মেলনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার ওই প্রস্তাবটিতে ছিল ভাষা ও বর্ণনার চমৎকার মুন্সিয়ানা। প্যারিসে ইউনেস্কো সদর দফতরে প্রস্তাবটি পেঁৗছে ৯ সেপ্টেম্বর। অর্থাৎ শেষ সময়ের মাত্র একদিন আগে।
ইউনেস্কো সচিবালয়ে এ প্রস্তাব নিয়ে কিছুটা সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে বাজেটের সীমাবদ্ধতায় প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা উঁকি দেয়। ইউনেস্কোর মহাপরিচালক বাংলাদেশের প্রস্তাবটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য এক্সিকিউটিভ বোর্ডে পাঠানোর সুপারিশ করেন। এক্সিকিউটিভে পাঠানো মানে ঝুলে যাওয়া। অতীতের ঘটনা বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয়ে যায়, বোর্ডে গেলে প্রস্তাবটি সহসা আলোর মুখ দেখবে না। এছাড়া মহাপরিচালকের ওই সুপারিশের মন্তব্যও আমাদের তেমন অনুকূলে ছিল না। বাজেটের সীমাবদ্ধতা ছাড়াও তার 'যদি', 'কিন্তু' মিশ্রিত কিছু মন্তব্য বাংলাদেশের প্রস্তাবটির গুরুত্ব দুর্বল করে দেয়। সর্বোপরি রীতিমতো অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে প্রস্তাবটি। এমন হতাশাজনক পরিস্থিতিতে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভের আশা ছেড়ে দেওয়ার অবস্থা হয়। ওই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়োপযোগী কূটনৈতিক পদক্ষেপ পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। তার পদক্ষেপে শেষ আশা জাগিয়ে তোলে ইউনেস্কোর অধিবেশনে যোগদানকারী বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল। শিক্ষামন্ত্রী এএসএইচকে সাদেক, ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ও ইউনেস্কো মহাপরিচালকের বিশেষ উপদেষ্টা তোজাম্মেল হক (টনি হক) ওই সময় বেশ কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন।
টনি হক ও মোয়াজ্জেম আলী একটি বিশেষ বৈঠক করেন ইউনেস্কোর ডেপুটি মহাসচিব কলিন পাওয়ারের সঙ্গে। তারা তাকে বোঝাতে সক্ষম হন আমাদের প্রস্তাবের আন্তর্জাতিক মানমর্যাদার বিষয়টি। ওই প্রস্তাবের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছিল_ পৃথিবীর বুক থেকে দ্রুত বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলোকে রক্ষা এবং তা টিকিয়ে রাখতে বৃহত্তর সচেতনতা গড়ে তোলার কথা। এক্ষেত্রে ইউনেস্কোর পদক্ষেপ গ্রহণের বাস্তবতা-সম্ভাব্যতাও তুলে ধরা হয় সারসংক্ষেপে। এছাড়া সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে এ প্রস্তাবের স্বপক্ষে আয়ত্তে আনতে দূতিয়ালির বিরল স্বাক্ষর রাখেন টনি হক ও মোয়াজ্জেম আলী।
তাদের দূতিয়ালির ফলাফল মেলে সম্মেলনে। ২৮টি সদস্য রাষ্ট্র সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রস্তাবকে লিখিতভাবে সমর্থন জানায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে_ এই ২৮ রাষ্ট্রের মধ্যে ছিল পাকিস্তানও। এরপরও টান টান প্রতীক্ষা। ইউনেস্কোর টেকনিক্যাল কমিটি কমিশন-২-এ বাংলাদেশের প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয় ১২ নভেম্বর। যথারীতি শুরু হয় প্রস্তাবের ওপর আলোচ্যসূচি কার্যক্রম। কমিশনের সভাপতি স্লোভাকিয়ার লুডোভিট মোলনার একের পর এক প্রস্তাব উত্থাপন করতে থাকেন। উত্থাপনের পর কোনোটি নিয়ে বিতর্ক চলে। কোনোটিতে আসে সংশোধনী। কোনোটি গৃহীত বা বাতিল। স্থানীয় সময় বিকাল ৩টায় উত্থাপিত হয় ২১-কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাব। বাংলাদেশের জন্য এটি এক ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণ। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় ৫০০ প্রতিনিধি। সভাপতি পরপর দু'বার প্রশ্ন করে জানতে চান_ প্রস্তাবের ওপর কারও কোনো আপত্তি বা মন্তব্য আছে কি না? সম্মেলনে পিনপতন নীরবতা। না, কারও কণ্ঠে কোনো আপত্তি নেই_ মন্তব্যও নেই। সভাপতি তিনবার হাতুড়ি পেটালেন। দরাজকণ্ঠে ঘোষণা দিলেন_ প্রস্তাবটি গৃহীত হলো। তুমুল হাততালি। সম্মেলনস্থল মুখরিত। সারা দুনিয়ার সংবাদ মাধ্যমে এটি সেদিনের ব্রেকিং নিউজ। বাংলাদেশে উৎসবের বন্যা। উচ্ছ্বাস-আনন্দের ছটা।
কমিশন-২-এ পাস হওয়া প্রস্তাবটি সাধারণ সম্মেলনের রুটিন বিষয় হিসেবে গৃহীত হয় ১৭ নভেম্বর। ৪ জানুয়ারি ২০০০ ইস্যু হয় ইউনেস্কোর মহাপরিচালক কাইচিরো মাটসুরার এ মর্মে ঐতিহাসিক চিঠি। চিঠিতে ইউনেস্কোর সব সদস্য রাষ্ট্রকে তখন থেকেই প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের আহ্বান জানান তিনি। ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি দিয়ে শুধু বাংলা ভাষার জন্য আমাদের সংগ্রামের স্বীকৃতিই দেয়নি, অমর একুশের শহীদদের আত্মদানের মর্যাদাও দিয়েছে। জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে আমাদের করেছে মহিমান্বিত । এ মর্যাদার স্বীকৃতি দিতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে এসেছে ২১'র সিঁড়ি বেয়ে '৭১র স্বাধীনতার কথাও। বিশ্বের প্রায় দু'শ দেশে এখন প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপিত হচ্ছে। বাংলায় কথা বলছে বিশ্বের প্রায় ১৮ কোটি মানুষ। বিশ্ব আরও বেশি করে জানছে ঢাকার বুকে ১৯৫২'র ভাষা আন্দোলনের অনন্য ইতিহাস। সেই সঙ্গে জানছে এ ইতিহাসের নায়কদের কথা। বাংলার-বাঙালির কথা। বাংলাদেশের কথা।
সূত্র বাংলাদেশ প্রতিদিন
সূত্র বাংলাদেশ প্রতিদিন
0 comments: