বৈশাখী মেলা ধরে রেখেছে বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্য
যেসব জাতি নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর বীরত্বগাথা নিয়ে গর্ববোধ করতে পারে বাঙালি তার অন্যতম। বাঙালির রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস
। বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন উৎসব, পালা-পার্বণ ও অনুষ্ঠান। এসবের মধ্যে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বৈশাখী মেলার আয়োজন বাঙালির একটি শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য।
বিভিন্ন দেশ ও জাতির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাদের বর্ষবরণের ইতিহাস। বাঙালির নববর্ষ উদযাপনেও স্বকীয়তা আছে। তা হল, পুরনো জীর্ণতাকে ধুয়ে-মুছে সুন্দর আগামীর প্রত্যাশা। দুঃখ-বেদনা ও নৈরাশ্য ভুলে বাঙালি হাজারো সমস্যার আবর্তে থেকেও নববর্ষ বরণের মাধ্যমে আগামীর সুন্দর স্বপ্নকে বুকে লালন করে আসছে যুগ যুগ ধরে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৈশাখকে বরণের আহ্বান জানিয়েছেন এভাবে : ‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ/ তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আর্জবনা দূর হয়ে যাক।’
নববর্ষের সঙ্গে এদেশের মানুষের গভীর আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক রয়েছে বহু আগে থেকেই। আমাদের দেশে বিভিন্ন উৎসব ও উপলক্ষ সামনে রেখে প্রায় সারা বছরই বিভিন্ন মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বিভিন্ন মেলা অনুষ্ঠিত হলেও এগুলো শুধু বৈশাখী মেলা নামে পরিচিত না হয়ে অন্যান্য নামেও অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এসব মেলা কোথাও বর্ষবরণ মেলা, নববর্ষ মেলা, বান্নি মেলা বা অন্য নামে পরিচিত। এসব মেলায় বিভিন্ন কৃষজাত পণ্য, মৌসুমী ফলমূল, ক্ষুদ্র, কুটির ও হস্তশিল্প পণ্য এবং হালে আধুনিক শিল্পে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর বিপুল সমাহার ঘটে। মেলায় থাকে উৎসবের আমেজ। শ্রেণী-পেশা, জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও বয়স নির্বিশেষে মেলায় নামে মানুষের ঢল। সাজগোজ করে কেনা-কাটা ছাড়াও মেলা যেন পরিণত হয় পাড়া-প্রতিবেশী, আÍীয়-স্বজন, শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীসহ সব মানুষের মিলনক্ষেত্র।
কামার, কুমার, ছুতার ও তাঁতিসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ তাদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর পসরা সাজিয়ে বসে মেলায়। বিভিন্ন কৃষিজ পণ্য, মাদুর, শীতল পাটি, বাঁশ ও বেতের পণ্য, ডালা, কুলা, চালুন, মোড়া, চরকি, পুতুল, বাঁশের বাঁশি, মাটির হাঁড়ি-বাসন, কলস, কাঠ ও মাটির খেলনা, লাটিম, বেলুন, পাখা, পুঁতির মালা, ঝিনুকের পণ্য, রকমারি কাচের ও প্লাস্টিকের চুড়ি, ঘুড়ি-লাটাই, শতরঞ্জি, শাড়ি, নকশিকাঁথা, কৃত্রিম ফুল, বাহারি গহনাসহ আরও অনেক কিছুই মেলায় মেলে। আরও পাওয়া যায় বাতাসা, কদমা, মুরালি, মণ্ডা-মিঠাই, জিলাপি, খৈ, মুড়ি-মুড়কি, মোয়া, তিলের খাজা, হাওয়াই মিঠাই, বুট-বাদাম, নানা রঙের শরবত, চানাচুর ভাজাসহ নানা খাদ্যদ্রব্য। এরকম হাজারো পণ্যসামগ্রীর সমাহার ছাড়াও মেলায় আনন্দ ও বিনোদনের জন্য থাকে আমাদের ঐতিহ্যবাহী বহুবিধ আয়োজন। আঞ্চলিক গানের আসর, ভাওয়াইয়া ও ভাটিয়ালি, পালাগান, জারি ও মারফতি এবং বিজয় ও বিচ্ছেদের গান গ্রামীণ মেলার অন্যতম আকর্ষণ। মানুষের নিরানন্দময় জীবনে ক্ষণিকের জন্য হলেও তা বয়ে আনে আনন্দের সুবাতাস।
আমাদের সমাজে মেলার যে দিকটি আজও অক্ষুণœ রয়েছে তা হল মেলার সর্বজনীনতা। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, পেশা, নারী-পুরুষ ও বয়স নির্বিশেষে মেলায় আসা মানুষগুলো যেন একাকার হয়ে যায়। মেলায় সবাই যেন এক ও অভিন্ন। এখানে সবার পরিচয় মানুষ, শুধু মেলার মানুষ। এ যেন বাঙালি ঐতিহ্যের আরেক বহিঃপ্রকাশ। এভাবে এগিয়ে যাক বৈশাখী মেলা। টিকে থাকুক বাঙালির এ ঐতিহ্য।
0 comments: