মানুষের মহাকাশ বিজয় এর ইতি কথা!!
মহাকাশ ভ্রমণের কথা তো আপনারা নিশ্চয়ই জানেন। ওই যে যারা সাদা রঙের অদ্ভূত অদ্ভূত সব জামা-কাপড় পরে রকেটে চড়ে পৃথিবীর বাইরে আকাশে গিয়ে ঘুরে আসেন। আপনারা অনেকেই নিশ্চয়ই স্বপ্নও দেখেন, একদিন আমরও মহাকাশে গিয়ে ঘুরে আসবো। যারা মহাকাশে গিয়ে ঘুরে আসেন তাদের কি বলে জানেন? কসমোনট। পৃথিবীর প্রথম কসমোনটের নাম তো আপনার সবাই-ই জাজানেন, ইউরি গ্যাগারিন। আর ১২ এপ্রিলে কিন্তু ইউরি গ্যাগারিনের মহাকাশ ভ্রমণের ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে। একবার চিন্তা করে দেখেন, মানুষের প্রথম মহাকাশ অভিযানের ৫০ বছর পূর্তি হয়েছে! আজ থেকে আরও ৫০ বছর আগেই মানুষ মহাকাশ জয় করেছিলো! তো, এই ৫০ বছর পূর্তির আগে আগেই চলেন আমরা ইউরি গ্যাগারিনের সেই মহাকাশ জয়ের গল্প শুনে আসি
।
।
মহাকাশ জয়ের আগের কথা
মহাকাশ তো বরাবরই খুবই আকর্ষণীয় আর মজার একটা বিষয়। এই আকাশ আর তার ওপারের জগত নিয়ে সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ কতোই না জল্পনা-কল্পনা করতো। কিন্তু একদিন এই আকাশও আর মানুষের অজেয় রইলো না। ১৯৪৪ সালে জার্মানির মহাকাশযান এ-৪ ঘুরে এলো মহাকাশ থেকে। ওটাতে অবশ্য কোনো প্রাণীই ছিলো না। তবে চল্লিশের দশকেই মহাকাশযানের সঙ্গে বিভিন্ন প্রাণীকেও পাঠানো শুরু হলো। ১৯৪৭ সালে আমেরিকা ভি টু রকেটে পাঠালো কতোগুলো ফলের মাছিকে। এরপর ১৯৪৯ সালে পাঠালো ‘আলবার্ট’ নামের এক বানরকে। কিন্তু ও তো যেতেই পারলো না মহাকাশে। তার আগেই মারা গেলো আলবার্ট।
‘লাইকা’র নাম তো শুনেছেন-ই। ওর আগেই অবশ্য আরো অনেক বানর আর কুকুর মহাকাশে ঘুরতে গিয়েছিলো। ওরা কেউ-ই যেমন পৃথিবীতে জীবিত ফিরে আসতে পারেনি, তেমনি ওরা কেউ পৃথিবীকে ঘিরে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরতেও পারেনি, মহাকাশে যাওয়া পর্যন্তই ওদের যাত্রা সীমাবদ্ধ ছিলো। তবে এবার কিন্তু রাশিয়ান এই কুকুর কেবল মহাকাশে গিয়েই ওর ভ্রমণ সীমাবদ্ধ রাখলো না। ও পৃথিবীর চারপাশে একবার পাকও খেয়ে আসলো। তবে ও-ও কিন্তু পৃথিবীতে জীবিত ফিরতে পারলো না। তার আগেই মারা গেলো। কিন্তু ভাবেন একবার, কতো ভাগ্যবান ওরা। ঠিক ঠিক মহাকাশে ঘুরতে পেরেছে ওরা।
প্রথম মহাকাশ ঘুরে আবার জীবিত ফিরে এলো ‘আব্ল’ আর ‘বাকের’ নামের দুই বানর। মার্কিন রকেট জুপিটার এএম১৮-তে করে ওরা ঘুরে এলো মহাকাশ থেকে। আর সেই সঙ্গে এবার বিজ্ঞানীরাও চিন্তা-ভাবনা শুরু করলেন, এবার তবে মানুষই ঘুরে আসুক মহাকাশ থেকে। এই কাজের জন্যই তো বিজ্ঞানীরা সেই কবে থেকে প্রহর গুণছিলেন!
শুরু হলো পরিকল্পনা
একটা জিনিস কি খেয়াল করছেন, স্কুলে প্রথম হওয়া নিয়ে সবার মধ্যে যেই প্রতিযোগিতা চলে, সেই প্রতিযোগিতার জন্যই কিন্তু সাবাই আরো বেশি বেশি করে পড়াশুনা করে। একই ভাবে মানুষের মহাকাশ অভিযানগুলো যে এতো দ্রুত সাফল্য পাচ্ছিলো, তারও কিন্তু একটা কারণ আছে। তখন আবার এটা নিয়ে আমেরিকা আর রাশিয়ার মধ্যে চলছিলো ভীষণ প্রতিযোগিতা। কে কার আগে মহাকাশ জয় করতে পারে তাই নিয়ে ওরা রীতিমতো কোমর বেঁধে লেগে গেছে। আর তাই তো দেদেখন না, প্রথম মহাকাশে প্রাণী পাঠালো আমেরিকা। আর তার জবাব দিলো রাশিয়া লাইকা'কে দিয়ে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করিয়ে। আমেরিকা আবার তার পাল্টা জবাব দিলো আব্ল আর বাকেরকে মহাকাশ ঘুরিয়ে জীবিত ফিরিয়ে এনে। এই প্রতিযোগিতার ধারায় মহাকাশে প্রথম মানুষ পাঠানো নিয়েও আমেরিকা আর রাশিয়ার মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেলো। আর সেই প্রতিযোগিতায় আবারও এগিয়ে যাওয়ার জন্য রাশিয়া নামলো আটঘাঁট বেঁধে। মানুষকে কিভাবে রকেটে করে মহাকাশ ঘুরিয়ে আনা যায় এই নিয়ে ওরা ‘ভস্তক প্রোগ্রাম’ নামে এক নতুন প্রজেক্টই হাতে নিয়ে ফেললো।
যেহেতু এবার আর কুকুর কি বানর যাচ্ছে না, যাচ্ছে এক জলজ্যান্ত মানুষ, তাকে কি আর জীবিত না আনলে হয়? সুতরাং এবার ওরা অনেক বেশি সতর্ক হয়ে পরিকল্পনা করতে লাগলো। ওই এক অভিযানের জন্য ১৯৬০ সালের মে আর ’৬১ সালের মার্চের মধ্যে ওরা একগাদা পরীক্ষামূলক মহাকাশ অভিযান করে ফেললো। তার সবগুলো অবশ্য সফলও হয়নি। কিন্তু শেষ দুটি হলো পুরোপুরি সফল। আর তাতে উৎসাহিত হয়ে বিজ্ঞানীরা ঠিক করলেন, আর পরীক্ষায় কাজ নেই। এবার আসল কাজ শুরু করা যাক। এবার মানুষই যাবে, আর কোনো প্রাণীকে পাঠানোর দরকার নেই।
যেমনি কথা, তেমনি কাজ। ‘ভস্তক- ১’ তৈরি হতে লাগলো মহাকাশে প্রথম মানবকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু ওতে চড়ে যে যাবে মহাশূন্যে, তারও তো প্রস্তুত হওয়া চাই, নাকি বলেন? সুতরাং সোভিয়েত স্পেস প্রোগ্রামের ২০ জন পাইলটকে নিয়ে শুরু হলো একটা স্পেস ট্রেনিং প্রোগ্রাম। আর শেষমেশ তা গিয়ে দাঁড়ালো দুইজনের প্রতিযোগিতায়- ইউরি গ্যাগারিন আর গেরমান তিতোভ’র। কিন্তু শেষপর্যন্ত টিকে গেলেন ইউরি-ই। আর তার টিকে যাওয়ার অনেকগুলো কারণের একটা ছিলো খুবই মজার- তিনি যে খাটো ছিলেন! কী, খুব অবাক হচ্ছেন? আসলে ভস্তকের ক্যাপসুলের ভেতরের জায়গাটা তো ছিলো খুবই ছোটো। তবে তিতোভ’ও কিন্তু খুব একটা লম্বা ছিলেন না। তবে ইউরি’র চেয়ে অবশ্য লম্বা ছিলেন।
এসব অভিযানে অবশ্য ব্যাকআপ ক্রু-ও রাখা হয়। যাতে অভিযানের আগে আগে ইউরি অসুস্থ হয়ে পড়লেও অভিযান থেমে না যায়। প্রথম ব্যাকআপ ক্রু ছিলেন ওই তিতোভ-ই। আর দ্বিতীয় ব্যাকআপ ক্রু ছিলেন গ্রিগরি নেলুওবোভ।
ভস্তক-১-র সীমাবদ্ধতা
ভস্তক-১ ছিলো একেবারেই সেকেলে ধরনের একটা রকেট বা মহাকাশযান। আর ভস্তক প্রজেক্টেরও ওটাই ছিলো প্রথম রকেট। তাই ওটার অনেক কিছুই ছিলো না, যেগুলো না থাকার কথা এখনকার মহাকাশচারীরা চিন্তাও করতে পারে না। এই যেমন ধরেন, অন্য ভস্তক যানগুলোতেও একটা করে অতিরিক্ত স্পেসক্র্যাফট থাকতো, যার কাজ ছিলো সংকেত আদান-প্রদান করা। যাতে মহাকাশযানের সঙ্গে কন্ট্রোল রুমের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে না যায়। আবার মহাশূন্যে রকেটের গতিপথ পরিবর্তন করার জন্য যে ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয় তাকে বলে রেট্রোরকেট ইঞ্জিন। অন্তত একটা হলেও সেই ইঞ্জিন অতিরিক্ত রাখতে হয়, তাই না? নয়তো যদি মহাকাশে ওই ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়, তখন তো আর রকেট পৃথিবীতে ফিরতেই পারবে না। কিন্তু ওজন কমানোর জন্য সেটাও দেয়া হলো মাত্র ১টা। তবে ওটা নষ্ট হলে যাতে উদ্ধারকারী যান যাওয়া পর্যন্ত মহাকাশচারী বেঁচে থাকে, সেজন্য ১ দিনের মহাকাশ ভ্রমণে অতিরিক্ত খাবারই দেয়া হলো ১০ দিনের! আবার সবগুলো ভস্তক মহাকাশযানেরই কিন্তু একটা সমস্যা ছিলো। ওগুলো কিন্তু একবার লঞ্চ প্যাড থেকে লঞ্চ হলে আর সেখানে ফেরত আসতে পারতো না। মহাকাশচারীকে প্যারাস্যুট দিয়ে নামতে হতো।
আবার ভস্তক-১ এ একটা মজাও ছিলো। সেবারই তো প্রথম কোনো মানুষ যাচ্ছে মহাকাশে। ওখানে গিয়ে যে কী হবে, তা তো আর কেউ জানে না। দেখা গেলো, ইউরি ওখানে গিয়ে প্রথম প্রথম নিজেকেই সামলাতে পারছেন না। এবার ক্যাপসুলের এই দেয়ালে ধাক্কা খাচ্ছেন তো আরেকবার ওইদিকের দেয়ালে ধাক্কা খাচ্ছেন। কিংবা, মহাকাশযান যখন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে গিয়ে পৃথিবী থেকে বের হয়, তখন বায়ুস্তরের সঙ্গে রকেটের বাইরের গায়ে প্রচণ্ড ঘর্ষণ হয়। আপনার হাতে শক্ত করে ধরা একটা স্কেল আপনার কোনো বন্ধু টেনে বের করে ফেললে আপনার হাতের সঙ্গে স্কেলের যে রকম একটা ঘর্ষণ হয় অনেকটা সেরকম। ফলে রকেট খুবই গরম হয়ে যায়। তো সেটা এতোই গরম হয়ে গেলো, ইউরি হয়তো সেই গরমেই আধমরা হয়ে গেলেন, রকেট সামলাবেন কীভাবে? তাই ভস্তক-১ এর নিয়ন্ত্রণ রাখা হলো কন্ট্রোল রুমেই। পৃথিবী থেকেই ভস্তক-১ পরিচালনা করা হয়েছিলো। তবে যদি কোনো সমস্যা হয়, আর ইউরিকেই ভস্তক-১ পরিচালনা করতে হয়, তখন? মনে করেন, কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে ভস্তক-১ এর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। সেরকম ইমার্জেন্সি সময়ের জন্য ইউরিকে একটা গোপন কোড দেয়া হলো। আর ভস্তক-১ এর ভেতরের সব সুইচ লক করে দেয়া হলো। শুধুমাত্র ওই কোডটা দিলেই সুইচগুলো কাজ করবে।
মহাঅভিযানের আগের দিন
মহাঅভিযানের আগের দিন, মানে ১১ এপ্রিল। সকাল সকাল একটা বহনকারী রকেট দিয়ে মূল স্পেসক্র্যাফটটাকে নিয়ে আসা হলো লঞ্চ প্যাডে। তখন তখনই অবশ্য রকেটটাকে দাঁড় করানো হয়নি, শুইয়ে রাখা হয়েছিলো। আর ভস্তক প্রজেক্টের অন্যতম বিজ্ঞানী সার্জেই করোলোভ ঘুরে ঘুরে নানাভাবে শেষবারের মতো পরীক্ষা করে দেখলেন ভস্তক-১'কে। পরীক্ষা শেষ হলে ভস্তক-১ কে দাঁড় করানো হলো। ইউরি আর তিতোভ'কে শেষবারের মতো পুরো পরিকল্পনা ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়া হলো। পরদিন সকাল ১০টায় এই ভস্তকে করেই ইউরি উড়ে যাবেন পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে, প্রদক্ষিণ করে আসবেন পৃথিবীকে। প্রথম মানুষ হিসেবে পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে পদার্পণ করবেন ইউরি গ্যাগারিন।
দিনের শেষে প্রজেক্টের মনোবিজ্ঞানীরা তাদেরকে বললেন, পরের দিনের অভিযান নিয়ে কোনো কথা না বলতে। আর ওরাও গান শুনে, পুল খেলে আর আড্ডা মেরে সন্ধ্যেটা কাটিয়ে দিলেন। এক মহাঅভিযানের আগের রাত। সহজে কী আর ঘুম আসার কথা! তাই ডাক্তাররা ওঁদেরকে বললেন ঘুমের ওষুধ খেতে। কিন্তু তারা বললেন, দরকার নেই। আর তারা দুজনেই একটু পরে ভোঁসভোঁস করে নাক ডাকতে ডাকতে ঘুমিয়ে পড়লেন। যেন পরদিন কিছুই হবে না!
ভস্তক-১ ছিলো একেবারেই সেকেলে ধরনের একটা রকেট বা মহাকাশযান। আর ভস্তক প্রজেক্টেরও ওটাই ছিলো প্রথম রকেট। তাই ওটার অনেক কিছুই ছিলো না, যেগুলো না থাকার কথা এখনকার মহাকাশচারীরা চিন্তাও করতে পারে না। এই যেমন ধরেন, অন্য ভস্তক যানগুলোতেও একটা করে অতিরিক্ত স্পেসক্র্যাফট থাকতো, যার কাজ ছিলো সংকেত আদান-প্রদান করা। যাতে মহাকাশযানের সঙ্গে কন্ট্রোল রুমের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে না যায়। আবার মহাশূন্যে রকেটের গতিপথ পরিবর্তন করার জন্য যে ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয় তাকে বলে রেট্রোরকেট ইঞ্জিন। অন্তত একটা হলেও সেই ইঞ্জিন অতিরিক্ত রাখতে হয়, তাই না? নয়তো যদি মহাকাশে ওই ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়, তখন তো আর রকেট পৃথিবীতে ফিরতেই পারবে না। কিন্তু ওজন কমানোর জন্য সেটাও দেয়া হলো মাত্র ১টা। তবে ওটা নষ্ট হলে যাতে উদ্ধারকারী যান যাওয়া পর্যন্ত মহাকাশচারী বেঁচে থাকে, সেজন্য ১ দিনের মহাকাশ ভ্রমণে অতিরিক্ত খাবারই দেয়া হলো ১০ দিনের! আবার সবগুলো ভস্তক মহাকাশযানেরই কিন্তু একটা সমস্যা ছিলো। ওগুলো কিন্তু একবার লঞ্চ প্যাড থেকে লঞ্চ হলে আর সেখানে ফেরত আসতে পারতো না। মহাকাশচারীকে প্যারাস্যুট দিয়ে নামতে হতো।
আবার ভস্তক-১ এ একটা মজাও ছিলো। সেবারই তো প্রথম কোনো মানুষ যাচ্ছে মহাকাশে। ওখানে গিয়ে যে কী হবে, তা তো আর কেউ জানে না। দেখা গেলো, ইউরি ওখানে গিয়ে প্রথম প্রথম নিজেকেই সামলাতে পারছেন না। এবার ক্যাপসুলের এই দেয়ালে ধাক্কা খাচ্ছেন তো আরেকবার ওইদিকের দেয়ালে ধাক্কা খাচ্ছেন। কিংবা, মহাকাশযান যখন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে গিয়ে পৃথিবী থেকে বের হয়, তখন বায়ুস্তরের সঙ্গে রকেটের বাইরের গায়ে প্রচণ্ড ঘর্ষণ হয়। আপনার হাতে শক্ত করে ধরা একটা স্কেল আপনার কোনো বন্ধু টেনে বের করে ফেললে আপনার হাতের সঙ্গে স্কেলের যে রকম একটা ঘর্ষণ হয় অনেকটা সেরকম। ফলে রকেট খুবই গরম হয়ে যায়। তো সেটা এতোই গরম হয়ে গেলো, ইউরি হয়তো সেই গরমেই আধমরা হয়ে গেলেন, রকেট সামলাবেন কীভাবে? তাই ভস্তক-১ এর নিয়ন্ত্রণ রাখা হলো কন্ট্রোল রুমেই। পৃথিবী থেকেই ভস্তক-১ পরিচালনা করা হয়েছিলো। তবে যদি কোনো সমস্যা হয়, আর ইউরিকেই ভস্তক-১ পরিচালনা করতে হয়, তখন? মনে করেন, কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে ভস্তক-১ এর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। সেরকম ইমার্জেন্সি সময়ের জন্য ইউরিকে একটা গোপন কোড দেয়া হলো। আর ভস্তক-১ এর ভেতরের সব সুইচ লক করে দেয়া হলো। শুধুমাত্র ওই কোডটা দিলেই সুইচগুলো কাজ করবে।
মহাঅভিযানের আগের দিন
মহাঅভিযানের আগের দিন, মানে ১১ এপ্রিল। সকাল সকাল একটা বহনকারী রকেট দিয়ে মূল স্পেসক্র্যাফটটাকে নিয়ে আসা হলো লঞ্চ প্যাডে। তখন তখনই অবশ্য রকেটটাকে দাঁড় করানো হয়নি, শুইয়ে রাখা হয়েছিলো। আর ভস্তক প্রজেক্টের অন্যতম বিজ্ঞানী সার্জেই করোলোভ ঘুরে ঘুরে নানাভাবে শেষবারের মতো পরীক্ষা করে দেখলেন ভস্তক-১'কে। পরীক্ষা শেষ হলে ভস্তক-১ কে দাঁড় করানো হলো। ইউরি আর তিতোভ'কে শেষবারের মতো পুরো পরিকল্পনা ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়া হলো। পরদিন সকাল ১০টায় এই ভস্তকে করেই ইউরি উড়ে যাবেন পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে, প্রদক্ষিণ করে আসবেন পৃথিবীকে। প্রথম মানুষ হিসেবে পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে পদার্পণ করবেন ইউরি গ্যাগারিন।
দিনের শেষে প্রজেক্টের মনোবিজ্ঞানীরা তাদেরকে বললেন, পরের দিনের অভিযান নিয়ে কোনো কথা না বলতে। আর ওরাও গান শুনে, পুল খেলে আর আড্ডা মেরে সন্ধ্যেটা কাটিয়ে দিলেন। এক মহাঅভিযানের আগের রাত। সহজে কী আর ঘুম আসার কথা! তাই ডাক্তাররা ওঁদেরকে বললেন ঘুমের ওষুধ খেতে। কিন্তু তারা বললেন, দরকার নেই। আর তারা দুজনেই একটু পরে ভোঁসভোঁস করে নাক ডাকতে ডাকতে ঘুমিয়ে পড়লেন। যেন পরদিন কিছুই হবে না!
এবার দখলে মহাকাশ
পরদিন, ১২ এপ্রিল, ১৯৬১। ভোর সাড়ে ৫টায় উঠলেন ইউরি গ্যাগারিন আর তার ব্যাকআপ ক্রু গেরমান তিতোভ। আর তারপর মুখ ধুয়ে নাস্তা খেয়ে ইউরি পরলেন তাঁর স্পেসস্যুট। আর তারপর তিনি প্রবেশ করলেন ভস্তক-১ এ। ঠিক ৭:১০ এ চালু হলো ভস্তকের রেডিও কমিউনিকেশন সিস্টেম। কন্ট্রোলরুমের টিভি পর্দায় ভেসে উঠলো ইউরি গ্যাগারিনের ছবি। আর এর প্রায় ৪০ মিনিট পর ভস্তক-১ নড়েচড়ে উঠলো। ওটার হ্যাচ বন্ধ করে দেয়া হলো। কিন্তু তখনই দেখা দিলো গোল, হ্যাচ তো পুরোপুরি বন্ধ হচ্ছে না! কী ব্যাপার! তড়িঘড়ি করে ছুটে এলো টেকনিশিয়ানরা। প্রায় ১ ঘণ্টার চেষ্টার পর হ্যাচ পুরোপুরি বন্ধ হলো। আর এরমধ্যে তো সবার-ই টেনশনে মাথার চুল ছেঁড়ার উপক্রম। সার্জেই করোলোভের তো বুক ব্যথাই শুরু হয়ে গেলো, হার্ট অ্যাটাক-ই হলো কিনা কে জানে! আর ওই দিকে ইউরি ভস্তকের ভেতরে বসেও দিব্যি শান্ত আছেন। উনি উল্টো কন্ট্রোল রুমে অনুরোধ করলেন তাকে কিছু গান শোনাতে!
৬:০৭ -এ রওয়ানা হলো ভস্তক-১, ইউরি গ্যাগারিনকে নিয়ে। মানুষের ইতিহাসে প্রথম কোনো মানুষ পৃথিবী ছেড়ে বাইরে গেলেন, গেলেন মহাকাশে। পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশেও মানুষ তার রাজত্ব বিস্তার করলো। মহাকাশ পদানত হলো মানুষের কাছে। আর ৬:১৭-তে ভস্তক-১ তার কক্ষপথে পৌছে গেলো। ইউরি গ্যাগারিন পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করলেন।
তিনি রাশিয়ার উপর দিয়ে প্রদক্ষিণ শুরু করলেন। তারপর কামস্কাটকার কাছ দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের উপর দিয়ে নিউজিল্যান্ড আর চিলির মাঝপথ দিয়ে যেতে লাগলেন আটলান্টিকের দিকে। দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের একদম নিচ দিয়ে তিনি আটলান্টিকের উপর দিয়ে এগোতে লাগলেন আফ্রিকার আকাশের দিকে।
নায়ক ফিরলেন পৃথিবীর বুকে
মহাকাশযান কিন্তু পৃথিবীতে ফেরার জন্য ওই রেট্রোরকেট ইঞ্জিনের উপরই নির্ভর করে। সেই ইঞ্জিন মহাকাশের বুকে আবার একটা বিস্ফোরণ ঘটায় এবং সেই বিস্ফোরণের ফলে মহাকাশযান পৃথিবীর দিকে আসতে থাকে। আর একবার পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মধ্যে আসতে পারলেই তো হয়েছে, পৃথিবী একদম ওকে টেনে-হিঁচড়ে মাটিতে নামিয়ে ফেলবে। ভস্তক-১’এ রেট্রোরকেট ইঞ্জিন বিস্ফোরণ ঘটালো ৭:২৫-এ, আফ্রিকার দেশ অ্যাঙ্গোলার ঠিক উপরে।
ভস্তকের নামার কথা এঞ্জেল নামের এক জায়গায়। বিস্ফোরণ যখন ঘটলো, তখনো ভস্তক এঞ্জেল থেকে প্রায় ৮হাজার কিলোমিটার দূরে। কিন্তু এবার কী হলো, বিস্ফোরণের পর তো রেট্রোইঞ্জিন আর মূল স্পেসক্র্যাফটটা আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা। ইউরিকে নিয়ে শুধু ওর ক্যাপসুলটা ছুটবে ল্যান্ডিং পয়েন্টের দিকে। কিন্তু কতোগুলো তারের বান্ডিলে পেঁচিয়ে রেট্রোইঞ্জিনটা ইউরির ক্যাপসুলের সঙ্গেই আটকে রইলো। আর ক্যাপসুলও একেবারে লাটিমের মতো ঘুরতে লাগলো। কিন্তু মিশরের আকাশে আসতেই ওই তারের বান্ডিল ছিঁড়ে গেলো, আর রেট্রোইঞ্জিনও আলাদা হয়ে গেলো। আর ক্যাপসুলও ইউরিকে নিয়ে সোজা ছুটতে লাগলো ল্যান্ডিং পয়েন্টের দিকে।
ঠিক মাটি থেকে ৭ কিলোমিটার উঁচুতে থাকতে ক্যাপসুলের ঢাকনা খুলে দেয়া হলো। আর তার ২ সেকেন্ড পরে, মাটি থেকে আড়াই কিলোমিটার উঁচুতে থাকতে থাকতে ইউরি বেরিয়ে এলেন ক্যাপসুল থেকে। ক্যাপসুলটা প্রচণ্ড জোরে ধড়াম করে মাটিতে আছড়ে পরে আবার ক্রিকেট বলের মতো বাউন্স খেয়ে লাফিয়ে উঠলো ২-৩ মিটার উঁচুতে।
এর ঠিক ১০ মিনিট পরে, ১১৮ মিনিট দৈর্ঘ্যরে বিশ্বের প্রথম মহাকাশ ভ্রমণ শেষ করে ইউরি গ্যাগারিন আবার পৃথিবীর বুকে পা রাখলেন। উজ্জ্বল কমলা রঙের স্পেসস্যুট গায়ে, মাথায় সাদা রঙের হেলমেট, আর পিছে এক বিশাল প্যারাস্যুট নিয়ে মাটিতে নামলেন ইউরি গ্যাগারিন, বিশ্বের প্রথম মহাকাশচারী, প্রথম কসমোনট। আর তারপর কী হলো? এক কৃষক আর তার মেয়ে দেখলো এই দৃশ্য। দেখে তো ওরা ভয়ই পেয়ে গেলো। ইউরি যতোই ওদের দিকে আগায়, ওরা ততোই ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়! পরে ইউরি বললো, ও-ই সেই লোক, যে সোভিয়েত ইউনিয়নের রকেটে করে আকাশে গিয়েছিলো। ওর একটা ফোন দরকার, ও মস্কোতে কন্ট্রোল রুমে ফোন দেবে। তখনই ওরা বুঝলো, কে ও। অনেকে আবার ভাবতে বসলে নাকি, সোভিয়েত ইউনিয়ন আবার কী? ওটা রাশিয়ারই পুরোনো নাম।
ব্যস, ইউরি গ্যাগারিন হয়ে গেলেন রাশিয়ার মানুষের চোখের মণি। শুধু কি তাই, সারা পৃথিবীর মানুষই তো তাকে এক নামে চেনে। এতে কিন্তু তার একটু ক্ষতিই হয়ে গেলো। কারণ, এরকম একজন বিখ্যাত মানুষের জীবনের ঝুঁকি তো আর নেওয়া যায় না, তাই না? সুতরাং, তাকে আর মহাকাশ ভ্রমণেই পাঠানো হলো না, যদি তিনি মারা যান!
তিনি যেখানে ল্যান্ড করেছিলেন, এখন সেখানে কি আছে জানেন? সেখানে এখন একটা মনুমেন্ট পার্ক আছে। আর ঠিক যেখানে তিনি নেমেছিলেন সেখানে আছে এক উঁচু ভাস্কর্য- একটা রকেট দাড়ানো, আর তার সামনে একটা বেদীতে দাঁড়ানো ইউরি, এক হাতে স্পেস হেলমেট, আরেক হাতে সবাইকে তিনি স্যালুট করছেন।
সূত্র: বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম এন্ড ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট
0 comments: