বিস্ময়কর ও রহস্যময় "নাজকা লাইন"
নাজকা লাইন সম্পর্কে বলার আগে জিওগ্লিপস সম্পর্কে একটু ধারণা দিয়ে রাখি। উন্মুক্ত প্রান্তরে (মাটি, পাথুরে বা বালুময় মরু) ছবি আঁকাআঁকিকে বলা হয় জিওগ্লিপস। মূলত জিওগ্লিপসের বাংলা হলো ভূমিতে খোদাইকৃত নকশা। সাধারণত জিওগ্লিপস ৪ মিটার থেকে কয়েকশ’ মিটার পর্যন্ত বড় হতে পারে। তবে জিওগ্লিপসের মূল বৈশিষ্ট্য হলো ভূমিতে দাঁড়িয়ে আপনি এই আঁকাআঁকি বা নকশাকে ঠিক বুঝতে পারবেন না। আপনাকে ওপর থেকে নজর দিতে হবে। অঙ্কিত নকশা বা ছবিটি স্পষ্ট বোঝার জন্য জিওগ্লিপসের আকারভেদে কয়েকশ’ ফুট ওপরে ওঠার প্রয়োজন পড়তে পারে। আর নাজকা লাইন হলো প্রাচীন যুগের মানুষদের তৈরি জিওগ্লিপস।
অবস্থান ও আবিষ্কার
নাজকা লাইনের অবস্থান পেরুর নাজকা মরুভূমিতে। স্থানটি লিমা শহর থেকে ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণে নাজকা এবং পাল্পা শহরের মাঝে অবস্থিত। মরুভূমিটির প্রায় ৪৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকার বিভিন্নস্থানে আঁকা হয়েছে অজস্র জীবজন্তু, ফুল, গাছ, এলিয়েন ও অসংখ্য জ্যামিতিক নকশা, যার কোনো কোনোটি আবার ২০০ মিটার পর্যন্ত বড়। নাজকা লাইন প্রথম আবিষ্কার হয় ১৯৩০ সালের দিকে, যখন এই এলাকা দিয়ে প্রথম বিমান চলাচল শুরু হয়। বিমানের যাত্রীরা এই বিশাল নকশা ও ছবি দেখে পত্রিকা অফিসে জানালে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং তখন থেকে এখন পর্যন্ত নাজকা লাইন পৃথিবীর অন্যতম রহস্যময় স্থান বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।কে কখন কীভাবে এ ছবিগুলো একেছে???
নাজকা লাইন কাদের তৈরি এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। তবে বেশিরভাগ গবেষকদের ধারণা, স্থানীয় বাসিন্দারা খ্রি.পূর্ব ২০০-৬৫০ খ্রিস্টাব্দের মাঝে এ নকশাগুলো এঁকেছিল।
যদিও অনেকেই প্রশ্ন তুলেন সে সময় তো ছিল না কোনো উন্নত প্রযুক্তি, ছিল না কোনো উন্নত যন্ত্রপাতি— তাহলে ছবিগুলো পাথুরে মরুতে আঁকা হলো কীভাবে? নাজকাতে নকশা ও ছবি আঁকা হয়েছে আয়রন অক্সাইডসমৃদ্ধ লালচে-বাদামি নূড়ি পাথর সরিয়ে ভেতরের অপেক্ষাকৃত সাদা মাটিকে উন্মোচন করে এবং বেশিরভাগ লাইনগুলোই ৪-৬ ইঞ্চি গভীর, যা শক্ত কাঠের টুকরো এবং পাথর দ্বারা করা সম্ভব। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, নাজকার অধিবাসীরা কাঠ দিয়েই লাইন খোদাই করেছিল। কারণ কিছু নকশার শেষপ্রান্তে কাঠের লম্বা টুকরো পাওয়া গেছে। তবে মূল রহস্য হলো—আঁকা ছবিগুলো ঠিক নকশামত হচ্ছে কিনা তা তারা দেখেছিল কীভাবে?
আগেই বলা হয়েছে, জিওগ্লিপস বোঝার জন্য আপনাকে ভূমি থেকে উপরে উঠতে হবে। যার ফলে অবশ্যই ছবিগুলো আঁকার সময় তা নকশামাফিক ঠিকমত আঁকা হচ্ছে কিনা এবং আঁকা শেষ হলে তা ঠিকমত আঁকা হলো কিনা তা দেখার জন্য কাউকে না কাউকে উপরে উঠতেই হয়েছিল। এখানে যুক্তি দেখানো যায়, উঁচু টাওয়ার নির্মাণ করে তাতে পর্যবেক্ষকরা উঠে দেখত কাজ ঠিকমত হচ্ছে বা হয়েছে কিনা। কিন্তু নাজকা লাইনের বেশিরভাগ ছবিই এতো বিশাল যে তা দেখতে হলে কমপক্ষে শতাধিক ফুট উপরে ওঠার প্রয়োজন। প্রাচীন ওই সভ্যতার পক্ষে তো এটা সম্পূর্ণ অসম্ভব। জিম উডম্যানসহ কিছু গবেষক ধারণা দেন নাজকার প্রাচীন বাসিন্দারা বেলুন আবিষ্কার করেছিল এবং তা দিয়ে তারা আকাশে উড়তে পারত। যদিও এ যুক্তি মোটেও ধোপে টিকে না। কারণ বেলুন আবিষ্কার যদি তারা করতেই পারত তাহলে সে প্রযুক্তি হঠাত্ হারিয়ে গেল কেন? কেন ১৭৮০ সালে এসে আবার তাহলে মানুষকে বেলুন আবিষ্কার করতে হয়? তাদের পরবর্তী প্রজন্ম কেন বেলুন আর বানাতে পারত না? আর বেলুন আবিষ্কার বা ব্যবহারের কোনো প্রমাণও তো আশপাশে পাওয়া যায়নি। অনেক গবেষক ধারণা দেন, প্রথম ছোট নকশা তৈরি করে তারপর এর অনুকরণে বড় করে ছবি আঁকা হয়েছে। কিন্তু এ ধারণাও গ্রহণযোগ্য না পর্যবেক্ষণের সমস্যার কারণে।
নাজকার রহস্য তাই শেষ হয় না। বরং এসব কিছু নাজকাকে আরও রহস্যাভূত করে তুলে। অবশ্য ‘এরিখ ভন দানিকেন’সহ কিছু গবেষক ধারণা দেন, এই লাইনগুলো নাজকার প্রাচীন বাসিন্দারাই এঁকেছিল, তবে তারা এককভাবে নয়, ভিনগ্রহবাসীদের সাহায্য নিয়ে।
নাজকা লাইন তৈরির উদ্দেশ্য কি?
কীভাবে আঁকা হয়েছে তার চেয়েও বেশি রহস্য লুকিয়ে আছে কেন এই ছবি আর নকশা তৈরি করা হয়েছে তা নিয়ে।
এলাকাটি মরুময় এখানে বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। তাই এমন একটি স্থানে এ ধরনের জটিল সব নকশা আর ছবি আঁকার মানে কি হতে পারে তার কোনো কূলকিনারা করতে পারেননি গবেষকরা। তবে বেশিরভাগ গবেষকই ধারণা করেন, ধর্মীয় রীতিনীতির অংশ হিসেবে প্রাচীন নাজকার বাসিন্দারা এ ছবিগুলো এঁকেছিল। আকাশ থেকে সৃষ্টিকর্তা যেন দেখতে পারেন তাই এ বিশাল ছবিগুলো আঁকা হয়েছিল। কারও কারও ধারণা, এটি এক ধরনের অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল কেলেন্ডার। এখানে আঁকা মাকড়সা, পাখি ও গাছের প্রতীক বলে অবশ্য সবাই মেনে নেয়। ঠিক একই কারণে অনেকে মনে করেন, বৃষ্টিপাতের জন্য প্রার্থনা ও পানি প্রবাহের লাইনের জন্য এগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু এই ধারণাও ঠিক গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এলাকাটির জলবায়ু অতীতে খুব বেশি যে পরিবর্তিত ছিল এমন কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না। তবে সাম্প্রতিককালে কম্পিউটারের দ্বারা পরীক্ষায় একটি আশ্চর্যজনক তথ্য পাওয়া যায়। নাজকাতে আঁকা একটি বিশালাকার মাকড়সার ছবির সঙ্গে অরিয়ন নক্ষত্রপুঞ্জের নকশার বেশ সামঞ্জস্য পাওয়া যায়।
যা হোক, বিজ্ঞানী ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের নাজকা রহস্য উদ্ধারে ব্যর্থতা এঁকে নিয়ে কিছু আজব তত্ত্ব চালু করেছে। সুইস গবেষক এরিখ ভন দানিকেনের মতে, নাজকা লাইন এলিয়েনদের সহায়তায় নাজকার প্রাচীন মানুষরাই তৈরি করেছিল এবং এটি মূলত এলিয়েনদের বিমানবন্দর। যেখানে তাদের স্পেশসিপ ওঠানামা করত এবং এখানে আঁকা নানা নকশা মূলত স্পেশসিপ ওঠানামার নানা সঙ্কেত। যদিও দানিকেনের তত্ত্ব বেশ চমকপ্রদ কিন্তু তার তত্ত্ব কোনো গবেষকই পাত্তা দিতে চান না এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত কোনো প্রমাণ না দিতে পারায়।
তথ্য ও ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা
দারুন হয়েছে
ReplyDelete