মাহে রমজান এলো বছর ঘুরে মুমিন মুসলমানের দ্বারে দ্বারে
মাহে রমজান, পবিত্র আল-কুরআন নাজিলের মাস : রহমত ও বরকতের মাস
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন: রমজান মাস, এতে নাজিল হয়েছে আল-কুরআন, যা মানুষের দিশারি এবং স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী। (সূরা বাকারা : ১৮৪)
রমজান মাসে মানুষের হেদায়াত ও আলোকবর্তিকা যেমন নাজিল হয়েছে তেমনি আল্লাহ র রহমত হিসেবে এসেছে সিয়াম। তাই এ দুই নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে বেশি বেশি করে কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত।
প্রতি বছর রমজান মাসে জিবরাইল (আ:) রাসূল (সাঃ)-কে পূর্ণ কুরআন শোনাতেন এবং রাসূল (সাঃ) -ও তাকে পূর্ণ কুরআন শোনাতেন। আর জীবনের শেষ রমজানে আল্লাহর রাসূল দু’বার পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করেছেন। সহিহ মুসলিমের হাদীস দ্বারা এটা প্রমাণিত।
যখন রমজানের আগমন হত তখন রাসূলে করিম (সাঃ) অতিশয় আনন্দিত হতেন, তাঁর সাহাবাদের বলতেন, তোমাদের দ্বারে বরকতময় মাস রমজান এসেছে। এরপর তিনি এ মাসের কিছু ফযীলত বর্ণনা করে বলতেন, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য সিয়াম পালন ফরজ করেছেন। এ মাসে আকাশের দ্বারসমূহ খুলে দেয়া হয়। বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজাগুলো। অভিশপ্ত শয়তানকে বন্দি করা হয়। এ মাসে রয়েছে একটি রাত যা হাজার রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যে ব্যক্তি এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো সে মূলত সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল। (নাসায়ী)
আমাদের কর্তব্য আল্লাহ র এ অনুগ্রহের মূল্যায়ন করতে চেষ্টা করা, এ মাসের ফযীলত ও তাৎপর্য অনুধাবনে সচেষ্ট হওয়া ও ইবাদত-বন্দেগিসহ সকল কল্যানকর কাজে নিয়োজিত থাকা। সহি নিয়তে রোজা পালনের সাথে সব সময় দোয়া, তাছবীহ, কুরআন তেলাওয়াতে রত থাকতে হবে।
ইনশাল্লাহ রহমতের এই মাস রমজানে আমরা সকল ওয়াক্তের ফরজ ও সুন্নত নামাজ আদায় করবো এবং তারাবীহসহ তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের সর্বত্তোম চেষ্টা করবো এবং যতো বেশী পারা যায় কুরআন তেলাওয়াত করবো।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, সর্বোত্তম বাণী আল্লাহর কিতাব । [সহীহ মুসলিম]
নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, কুরআনকে আঁকড়ে ধরো , তাহলে কখনো বিপথগামী হবেনা। [মিশকাত]
মহানবী (সাঃ) বলেছেন, যে আল্লাহর কিতাবের পথ ধরে সে দুনিয়াতে বিপথগামী হয়না এবং পরকালে হয়না দুর্ভাগা । [মিশকাত]
নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, আমার উম্মতের সম্মানিত লোক হলো কুরআনের বাহক আর রাতের সাথীরা। [বায়হাকী]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, কুরআন উচ্চস্বরে পাঠকারী প্রকাশ্যে দান-খয়রাতকারীর অনুরূপ এবং গোপনে কুরআন পাঠকারী গোপনে দানকারীর মত। [কিতাবুস সালাত]
হযরত উম্মে হাবীবা (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি দৈনিক বার রাকাত নফল/সুন্নাত নামায আদায় করবে- এর বিনিময়ে আল্লাহ তা’য়ালা তার জন্য বেহেশতের মধ্যে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করবেন। [কিতাবুস সালাত](হাদীস নং-১২৫০)
আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, কিয়ামতের দিন কুরআনের পাঠককে বলা হবে, তুমি তা পাঠ করতে থাক এবং উপরে চড়তে (উঠতে) থাক। তুমি তাকে ধীরে সুস্থে পাঠ করতে থাক, যেরূপ তুমি দুনিয়াতে পাঠ করতে। কেননা তোমার সর্বশেষ বসবাসের স্থান (জান্নাত) ঐটিই যেখানে তোমার কুরআনের আয়াত শেষ হবে। [কিতাবুস সালাত](হাদীস নং-১৪৬৪)
আয়েশা (রা:) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করে এবং কুরআনে অভিজ্ঞও- সে ব্যক্তি অতি সম্মানিত ফেরেশতাদের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর যে ব্যক্তি কুরআন পাঠের সময় আটকে যায় এবং কষ্ট করে পড়ে, তার জন্য দু’টি বিনিময় অবধারিত। [কিতাবুস সালাত](হাদীস নং-১৪৫৪)
আয়েশা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, তোমরা সাধ্যানুযায়ী আমল কর। কেননা আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদের কোন আমলকে বন্ধ করেন না, যতক্ষণ না তোমরা নিজেরাই তা বন্ধ কর। কেননা আল্লাহ তাআলার নিকট ঐ আমলই অধিক পছন্দনীয় যা নিয়মিত আদায় করা হয়ে থাকে, যদিও পরিমাণে তা কম হয়। তিনি রাসুল (সাঃ) যখন কোন আমল শুরু করতেন, তখন তা নিয়মিতভাবে আদায় করতেন। [কিতাবুস সালাত](হাদীস নং-১৩৬৮)
পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা পাঠের ফজিলত বর্ননা করে মহানবী (সাঃ) এর বানী—
*এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিল-ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাঃ) ! কুরআন শরীফের কোন সূরাটি সর্বশ্রেষ্ঠ? মহানবী (সাঃ) বলিলেন, “সূরা এখলাস”।
ঐ ব্যক্তি আবারও জিজ্ঞাসা করিল-কুরআন শরীফের কোন আয়াতটি সর্বশ্রেষ্ঠ? মহানবী (সাঃ) বলিলেন, “আয়াতুল কুরসী”।
ঐ ব্যক্তি আবারও জিজ্ঞাসা করিল-ইয়া রাসুলাল্লাহ (সাঃ)! কুরআন মজীদের কোন আয়াতটি আপনার এবং আপনার উম্মতের অধিক উপকার করিবে? মহানবী (সাঃ) বলিলেন, “সূরা বাকারার শেষ অংশ।” আল্লাহ তায়ালার আরশের নিম্নস্হ রহমতের ভান্ডার হইতে উহা আসিয়াছে। তিনি উম্মতকে উহা দান করিয়াছেন। দুনিয়া ও আখিরাতে এমন কোন নিয়ামত নাই যাহা উহাতে নাই। (মিশকাত)*মহানবী (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি রাত্রিকালে “সূরা দুখান” পাঠ করে এবং প্রত্যুষে শয্যা ত্যাগ করে, ১২ হাজার ফেরেশতা তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। (তিরমিযী)*মহানবী (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি দিনের শুরুতে “সূরা ইয়াসীন”পাঠ করবে তার সমস্ত অভাব পূরন করে দেয়া হবে। (মিশকাত)*মহানবী (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি দুইশত বার “সূরা এখলাস” পাঠ করে, তার শুধু রীনের দায় ছাড়া ৫ বছরের অন্যান্য গুনাহ্ মাফ হয়ে যায়। (তিরমিযী, আহমাদ)*মহানবী (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি “সূরা কাহাফ”এর প্রথম তিন আয়াত নিয়মিত তিলাওয়াত করে সে দাজ্জালের ফিতনা হতে নিরাপদ তাকবে। (তিরমিযী)*মহানবী (সাঃ) বলেন, কুরআন শরীফে ৩০ আয়াতের একটি সূরা আছে উহার নাম “সূরা মূলক” যা পাঠকের জন্য ক্ষমা লাভ না করা পর্যন্ত সুপারিশ করতে থাকে। (তিরমিযী, আবু দাউদ)*মহানবী (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি রাত্রিকালে “সূরা আল-ইমরান” এর শেষ রুকু পাঠ করে, তার জন্য সারা রাত্রি নামাযে দাড়িয়ে থাকার সমতুল্য সওয়াব লিখিত হয়। (মিশকাত)*মহানবী (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক রাত্রে “সূরা ওয়াকিয়া” তিলাওয়াত করবে সে কখনও ভূখা থাকবে না। (বায়হাকী, মিশকাত)* মহানবী (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি ঘুমাবার সময় বিছানায় ডান পার্শ্বে শুয়ে একশত বার “কুল হুয়াল্লাহু আহাদ” পাঠ করে কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তায়ালা তাকে বলবেন, হে আমার বান্দা! তুমি ডান পার্শ্ব দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ কর। (তিরমিযী)*মহানবী (সাঃ) বলেন, ঘরের ভিতরে যিকির-তিলাওয়াত না করে তোমরা নিজেদের ঘরকে কবর বানাইয়া ফেলিও না। যে ঘরে “সূরা বাকারা” তিলাওয়াত করা হয় সেই ঘর হতে শয়তান পলায়ন করে। (মুসলিম)*মহানবী (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি জুমআ-বার রাত্রে “সূরা দুখান” পাঠ করে তার গোনাহ্সমুহ মাফ হয়ে যায়। (তিরমিযী)*মহানবী (সাঃ) বলেন, আল-কুরআনের হৃদয় হলো “সূরা ইয়াসীন”; যে ব্যক্তি “সূরা ইয়াসীন” পাঠ করে আল্লাহ্ তায়ালা তার আমল নামায় এর বিনিময়ে দশবার সম্পূর্ন কুরআন মজীদ পাঠ করার সওয়াব লিপিবদ্ধ করে দেন। (তিরমিযী)*মহানবী (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি জুমআর দিন “সূরা কাহাফ” তিলাওয়াত করে তার জন্য দুই জুমআর মধ্যবর্তী দিনগুলিতে নূরের ব্যবস্হা করা হয়। (বায়হাকী, মিশকাত)*মহানবী (সাঃ) বলেন, সূরা ফাতিহাতে প্রতিটি রোগের ঔষধ বিদ্যমান। (দারিমী, মিশকাত)*হযরত আনাস (সাঃ) বর্ননা করেন, এক ব্যক্তি আরয করিল, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাঃ)! আমি এই “কুল হুয়াল্লাহ” সূরাটিকে খুব ভালবাসি। মহানবী (সাঃ) বললেন, এই সূরার প্রতি তোমার ভালবাসা তোমাকে বেহেশতে প্রবেশ করাইবে। (তিরমিযী)*হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে খুবাইর (সাঃ) বর্ননা করেন, ভীষন অন্ধকার এক রাতে আমরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -কে খুঁজতে বের হলাম। তাঁর সাথে সাক্ষাত হলে তিনি বললেন-বল। আমি আরয করলাম, কি বলবো? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, সূরা এখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস ভোরে ও সন্ধ্যাকালে তিনবার পাঠ করিও। ইহাতে তোমার সকল প্রয়োজন মিটিয়া যাইবে। (তিরমিযী)
এবং রহমতের মাস রমজানে মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে বেশী বেশী দোয়া করতে হবে,
কিতাবুস সালাত
নুমান ইবন বাশীর (রা:) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, দু’আও একটি ইবাদাত। তোমাদের রব বলেনঃ তোমরা আমার নিকট দু‘আ কর। আমি তা কবুল করব। (হাদীস নং-১৪৭৯)
নুমান ইবন বাশীর (রা:) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, দু’আও একটি ইবাদাত। তোমাদের রব বলেনঃ তোমরা আমার নিকট দু‘আ কর। আমি তা কবুল করব। (হাদীস নং-১৪৭৯)
আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, ঐরূপ দু‘আ অতি সত্ত্বর কবুল হয়, যদি কেউ অনুপস্থিত ব্যক্তির জন্য দু‘আ করে। (হাদীস নং-১৫৩৫)
আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, তিন ব্যক্তির দু‘আ নিঃসন্দেহে কবুল হয়- পিতা-মাতার দু‘আ (সন্তানের জন্য), মুসাফিরের দু‘আ এবং মযলুম (নির্যাতিত) ব্যক্তির দু‘আ। (হাদীস নং-১৫৩৬)
সালমান (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, তোমাদের রব চিরঞ্জীব ও মহান দাতা। যখন কোন বান্দাহ হাত উঠিয়ে তাঁর নিকট দু‘আ করে, তখন তিনি তার খালি হাত ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন। (হাদীস নং-১৪৮৮)
আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, তোমাদের প্রত্যেকের দু‘আ কবুল হয়ে থাকে, যতক্ষণ না সে ব্যক্তি তার জন্য তাড়াহুড়া করে এবং এরূপ বলতে থাকে যে, আমি দু‘আ করলাম অথচ তা কবুল হয় নাই। (হাদীস নং-১৪৮৪)
রহমতের এই মাস রমজানে সহি নিয়তে রোজা রাখার পাশাপাশি আমাদের সকলেরই উচিত বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত করা ও মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া করা। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে সহি নিয়তে রোজা রাখার তৌফিক দান করুন। আমিন …
0 comments: