মানব সভ্যতায় আদিকাল থেকে অলঙ্কারের ব্যবহার চলে এসেছে অলঙ্কার ধর্মবিশ্বাস, সংস্কৃতি, রুচী, বোধ, মননশীলতা ও সৃজনশীল মানসিকতার বহিপ্রকাশ ...

ইসলামে নারী-পুরুষের অলঙ্কার পরিধানের বিধান!

3:23:00 AM Mainuddin 0 Comments


মানব সভ্যতায় আদিকাল থেকে অলঙ্কারের ব্যবহার চলে এসেছে অলঙ্কার ধর্মবিশ্বাস, সংস্কৃতি, রুচী, বোধ, মননশীলতা ও সৃজনশীল মানসিকতার বহিপ্রকাশ অলঙ্কারের মাধ্যমে মানুষের জীবনাচার, ঐতিহ্য-ইতিহাস এবং আর্থিক অবস্থা, সামাজিক মূল্যবোধ ও ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে।

অলঙ্কার প্রবর্তনের সূচনা কাহিনীরূপে কথিত আছে : হযরত ইবরাহীম (আ.) এর প্রথম স্ত্রী সারা তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরাকে সৌন্দর্যহানীর লক্ষ্যে কান ফুটো করে দেন পরবর্তীতে হযরত ইবরাহীম (আ.) হাজেরাকে কানে অলঙ্কার পরিয়ে দিলে তার সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি পায় এখান থেকেই অলঙ্কার ব্যবহারের প্রচলন ঘটে (আল্লাহই ভালো জানেন) কুরআনুল কারীমে অলঙ্কার ব্যবহারের ইতিহাস হযরত মূসা (আ.) এর সময়কাল (এবং তার পূর্বকাল) থেকে জানা যায় সূরা আরাফের ১৪৮ নম্বর আয়াতে এর বর্ণনা পাওয়া যায় সূরা নাহল এর ১৪ নম্বর আয়াতে অলঙ্কার হিসেবে মুক্তার ব্যবহারে উল্লেখ রয়েছে সূরা ফাতির এর ১২ নম্বর আয়াতে অলঙ্কার হিসেবে প্রবাল ব্যবহারের কথা এসেছে

বেহেশতবাসীদের অলঙ্কার ব্যবহার : এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে সূরা দাহার এর ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে জান্নাতবাসীদের রজত কাঁকন পরানো হবে সূরা কাহাফ এর ৩১ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে তাদের কাঞ্চন কঙ্কনে অলঙ্ককৃত হরা হবে সূরা হজ্জ এর ২৩ নম্বর আয়াতে ও সূরা ফাতির এর ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে সেথায় তাদের স্বর্ণবালা ও মানিক্যালঙ্কারে সজ্জিত করা হবে

উম্মুল মুমিনীন ও মহিলা সাহাবীদের অলঙ্কার ব্যবহার : প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর সহধর্মিনীগণও অলঙ্কার ব্যবহার করতেন হযরত মা আয়িশা (রা.) এর গলার হার হারানোর ঘটনা অত্যন্ত বিখ্যাত, যে বিষয়ে পরবর্তি পর্যায়ে কুরআনে আয়াতও নাযিল হয়েছে প্রায় মহিলা সাহাবীগণ অলঙ্কার ব্যবহার করতেন বিভিন্ন সময় মহিলা সাহাবীগণ জিহাদের ব্যয় নির্বাহের জন্য নিজেদের হাতের বালা খুলে দিয়েছেন বলে হাদীসে উল্লেখ আছে নবীজী (সা.) কোন কোন বয়ানে মহিলাদের অলঙ্কারের যাকাত প্রদানের প্রসঙ্গও আলোকপাত করেছেন যা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণীত

অলঙ্কারের সিদ্ধ ও নিষিদ্ধ ধাতুসমূহ : লোহা ও স্টীলের অলঙ্কার পরিধান করা মাকরূহ; কেননা দোযখীদের শাস্তিস্বরূপ লোহার বেড়ী পরানো হবে এ ছাড়া অন্য যে কোন ধাতু বা বস্তু নির্মিত অলঙ্কার পরিধান করা যাবে

পুরুষদের অলঙ্কার ব্যবহার : পুরুষের জন্য রূপার আংটি ব্যতিত সকল প্রকার অলঙ্কারই নিষিদ্ধ বিশেষ করে সোনার আংটি ও সোনার চেইনসহ যাতীয় স্বর্ণালঙ্কার সমপূর্ণরূপে নিষেধ

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর অলঙ্কার ব্যবহার : আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) অলঙ্কার ব্যবহার করতেন না রাষ্ট্রিয় দাফতরিক প্রয়োজনে সীল মোহর হিসেবে রূপার অঙ্গুটি ব্যবহার করেছেন তাতে লেখা ছিল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ তিনি এই আংটি ডান হাতে কনিষ্ঠাঙ্গুলে পরতেন তাই কারো মতে পুরুষ শুধু প্রয়োজনে আংটি ব্যবহার করতে পারবে, কারো কারো মতে পুরুষের জন্য সাধারণভাবে আংটি পরা অনুমোদিত; আবার কারো কারো মতে আংটি ব্যবহার করা সুন্নাত, তবে সর্বাবস্তায় সেটি হতে হবে রূপার

অলঙ্কার ব্যহারের অঙ্গসমূহ : পুরুষ শুধু হাতের আঙ্গুলেই রূপার আংটি পরতে পারবেন মহিলাগণ হাত, পা, নাক, কান, গলা, বাজু, কব্জি, হাতের আঙ্গুল, পায়ের নলা, পায়ের আঙ্গুল ও কোমরে অলঙ্কার পরিধান করতে পারবেন উল্লেখ্য যে, কান ফোঁড়ানো বা কান ফুটো করে তাতে অলঙ্কার ব্যবহার করা প্রমাণীত; কিন্তু নাক ফোঁড়ানো বা নাক ফুটো করে নাকে অলঙ্কারের ব্যবহার প্রমাণীত নয়

যেসব অঙ্গে অলঙ্কার ব্যবহার করা যাবে না : বর্তমানে আরো কিছু কিছু অঙ্গে অলঙ্কার ব্যবহার করতে দেখা যায়, যেমনঃ ঠোট, চোখ, নাভী, জিহ্বা; এসব স্থানে অলঙ্কার ব্যবহার করা অপসংস্কৃতি ও উগ্রতার বহিপ্রকাশ; তাই এসব অনুমোদিত নয় ।

অলঙ্কারের উপকরণ : অলঙ্কারের উপকরণ হিসেবে সাধারণত সোনা, রূপা, ব্রোঞ্জ, পিতল, তামা, দস্তা, কাঁসা, স্টীল, লোহা, কাঠ, ফলের বিচি, শামুক-ঝিনুক, পোড়ামাটি, কাঁচ, চাঁচ, রাবার, প্লাস্টিক, পাথর (হিরা, চুনী, পান্না, রুবী, মার্বেল) মুক্তা ইত্যাদি ব্যবহার হয়ে থাকে মহিলাদের জন্য এসব বস্তু ব্যবহারে বাধা নেই; পুরুষের জন্য রূপার আংটি ছাড়া অন্য কিছু ব্যবহার জায়েজ নেই।

অলঙ্কারের অনুমোদিত ও অনুমোদিত ডিজাইন বা নকশা : নকশা বা আকৃতি হিসেবে ফুল, ফল, লতা-পাতা, গাছ-পালা, নিসর্গ ও প্রকৃতি অলঙ্কারের ক্ষেত্রে অনুমোদিত ক্রুশ, সাপ-বিচ্ছু, পোকা-মাকড়, প্রাণী এবং হারাম বাদ্যযন্ত্র ও জুতা-স্যান্ডেল ইত্যাদি যাতে বিধর্মীদের বিশ্বাস, সভ্যতা, সংস্কৃতির ছাপ থাকে অথবা, অপসংস্কৃতি ও উচ্ছৃখলতা প্রকাশ পায়

প্রচলিত বিভিন্ন প্রকারের অলঙ্কারের নাম- নাকের অলঙ্কার: নাকফুল, বুট, নাকচাবী; নথ, নাকঠাঁসা, বুলবুলি, বালি, রেজবালি, চাঁদবালি/চন্দ্রবালি, নোলক, বোলক ইত্যাদি।

কানের অলঙ্কার : কানপাশা, কানের দুল, কানফুল, বৈঠাফুল, লটকাফুল, ঝুমকা, কানের বালি, মুড়কি ইত্যাদি

গলার অলঙ্কার : মালা, মুক্তার মালা, পুতির মালা, কাঠের মালা, চেইন, হার, চন্দ্রহার, সীতাহার, তাবিজ, লকেট, হাঁসুলী

হাতের কব্জির অলঙ্কার : চুড়ি, বালা, কাঁকন-কঙ্কন, শাঁখা, শঙ্খচুর, চুর, রুলি, ব্রেসলেট, ঘড়ি ইত্যাদি

হাতের বাজুর অলঙ্কার : বাজুবন্ধ, কালসী ইত্যাদি কোমরের অলঙ্কার: বিছা পায়ের অলঙ্কার: পায়েল, নূপুর, মল, খাড়ু ইত্যাদি

মাথার অলঙ্কার : টিকলী, চুলকাঁটা, খোঁপা, বেনী, রাবার ব্যান্ড, কাপড়ের ব্যান্ড, ক্লিপ, টিপ ক্লিপ, কালো ক্লিপ, কাঁকড়া ক্লিপ ইত্যাদি

বিশেষ দ্রষ্টব্য : ক্রুস বা ক্রস চিহ্নযুক্ত কোন অলঙ্কার ব্যবহার করা যাবে না; কারণ এটি খ্রিষ্টানদের ধর্ম বিশ্বাস ও সংস্কৃতির অংশ পৈতা (বিশেষ ধরণের কাঠের পুতির মালা) পরা যাবে না এবং সাদা শাঁখা, যা শাঁখ-শঙ্খ বা সামুদ্রিক শামুকের খোলস কেটে তৈরী করা হয় অথবা সে আদলে অন্য কিছু দিয়ে বানানো হয়; তা পরিধান করা মুসলিম রমণীদের জন্য বৈধ নয় কারণ এ উভয়টি হিন্দু সংস্কৃতি ও সনাতন ধর্ম বিশ্বাসের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়

অলঙ্কার ব্যবহারে ডান-বাম : হাদীস শরীফে আছে রসূলে কারীম (সা.) সকল কর্মে ডান দিককে অগ্রাধিকার দিতেন (সুনানে আবু দাঊদ) তাই যে কোন অলঙ্কার একক হলে ডান অঙ্গে পরা এবং ডান দিক থেকে পরতে শুরু করা সুন্নাত এই বিধান পুরুষ ও মহিলা সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য।

অলঙ্কার ও পর্দা : মনে রাখতে হবে অলঙ্কার পরিধান করে গায়রে মাহরাম বা পরপুরুষের সামনে বেপর্দা হওয়া কোনক্রমেই বৈধ নয় অলঙ্কার শুধু আপন ও অনুমোদিত পরিবেশে পরতে হবে বেপর্দা হওয়া এমনিতেই গুনাহ, অলঙ্কৃতাবস্থায় পর্দা লঙ্ঘণ করা আরো কঠিন গুনাহ।

মহর ও অলঙ্কার : বিয়ের সময় বরের পক্ষ থেকে কনেকে যে অলঙ্কার প্রদান করা হয়, তা মহর হিসেবে উল্লেখ করা থাকলে মহর হিসেবে গণ্য হবে; নচেৎ উপহার বা হাদিয়ারূপে পরিগণিত হবে পরবর্তিতে স্বামী স্ত্রীকে কোন অলঙ্কার দিলে তা মহর বলে নির্ধারণ করলে স্ত্রীর সম্মতি ক্রমে তা মহররূপে গণ্য হবে; নয়তো দান বা উপঢৌকন হবে।

অলঙ্কারের জাকাত : কারো মালিকানায় সোনা সাড়ে সাত ভরি বা বেশী থাকলে তাকে সম্পূর্ণ সোনার এবং রূপা সাড়ে বায়ান্ন ভরি বা বেশী থাকলে তাকে সম্পূর্ণ রূপার যাকাত প্রদান করতে হবে এই সোনা-রূপা অলঙ্কার হোক বা অন্য যাই হোক না কেন ব্যবহারের অলঙ্কারসহ যাবতীয় স্বর্ণ-রৌপ্য যাকাতের আওতাধীন ।

শেষ কথা : এমন অলঙ্কার ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয় যা ব্যবহারে শোভা বর্ধনের পাশাপাশি ব্যবহারকারীকে আকর্ষণীয়, মোহণীয়, কমনীয়, রুচীশীল, সংস্কৃতিবান, ঐতিহ্যশালী করে তুলবে এমন অলঙ্কার ব্যবহার করা সমীচিন নয় যা ব্যবহারকারীকে অশোভন, লোভনীয়, অহঙ্কারী, উচ্ছৃঙ্খল, অশ্লীল, বেহায়া-নির্লজ্জ ও উত্তেজক হিসেবে দর্শকের সম্মুখে প্রকাশ করবে নহে সুন্দর দামী পোষাকে ও অলঙ্করণে; সুন্দর হলো জ্ঞানে ও ভদ্র আচরণে।

0 comments: